ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অপব্যয়ের প্রকল্প

ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কোটি টাকা আয়— এমন একটি ধারণা সম্প্রতি গড়ে
উঠেছে দেশে। এরই আলোকে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়। যদিও ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য
বিশেষায়িত কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন এ খাতের
বিশেষজ্ঞরা।
তার পরও প্রশিক্ষণের জন্য ৩০৫ কোটি টাকা চেয়েছে মন্ত্রণালয়, যাকে
অস্বাভাবিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। এ জন্য ১৮০ কোটি টাকা দেয়া যেতে
পারে বলে মত দিয়েছে তারা। এরও বড় অংশ আবার অপচয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন
কমিশনের কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে বিভিন্ন মহল একে দেখছে কাল্পনিকতার মোড়কে
অর্থ অপচয়ের আয়োজন হিসেবে।
ফ্রিল্যান্সিং হলো এক ধরনের মুক্ত পেশা; যাতে নির্দিষ্ট কাজের বিনিময়ে
কোনো দক্ষ ব্যক্তি ঘরে বসেই বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পারিশ্রমিক পেয়ে
থাকেন। গত কয়েক বছরে পেশাটি তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ধারণা করা
হয়, প্রায় এক লাখ তরুণ-তরুণী এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনানুষ্ঠানিক পথে খাতটি
থেকে বাংলাদেশ পায় বছরে ৩ কোটি ডলারের মতো। ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের জন্য
আইসিটি মন্ত্রণালয় লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক একটি
প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের বিপরীতে ৩০৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দ
চেয়ে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রস্তাব পাঠায় আইসিটি মন্ত্রণালয়। এরপর
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় খাতভিত্তিক কার্যক্রম ও ব্যয় পর্যালোচনা করে ১২৫ কোটি
টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হিসাবে চিহ্নিত করে। এ প্রকল্পের বিপরীতে ১৮০ কোটি ৪০
লাখ টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে নারাজ পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক
অবকাঠামো বিভাগ। এ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পটি আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের
নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করবে পরিকল্পনা কমিশন।
এদিকে প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্ট
বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য বিশেষায়িত কোনো প্রশিক্ষণের
প্রয়োজন নেই। ডিপ্লোমা বা কারিগরি প্রশিক্ষণ হিসেবে ন্যূনতম ছয় মাস
প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। বিদেশে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কিছু প্রশিক্ষণও
দেয়া হয়। কিন্তু এ প্রকল্পে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের নামে সেমিনার, ডাটা
এন্ট্রি ও ছবি এডিটিংয়ের কাজ শেখানো হবে, যা অর্থ অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
বিগমাসটেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিস্টেম আর্কিটেক্ট অ্যান্ড
ইঞ্জিনিয়ার সাঈদ ইসলাম বলেন, পূর্ব-অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ফ্রিল্যান্সিং
প্রশিক্ষণের ৯৯ শতাংশ কার্যক্রমই ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য ফ্রিল্যান্সিং
প্রশিক্ষণ না দিয়ে দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। তরুণদের
উৎসাহী করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে আইসিটি খাতে অভিজ্ঞ ও
দক্ষরা উৎসাহী হন।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি
জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পের নথি থেকে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের
প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞাপন, মেলা আয়োজন, গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শক
নিয়োগ, ম্যানেজমেন্ট চার্জেস অব অনলাইন সাপোর্ট সার্ভিস, স্থানীয় ও বৈদেশিক
কর্মশালা/কনফারেন্স/বিদেশ ভ্রমণ খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়েছে। এর
প্রয়োজন নেই বলে মনে করছে কমিশন। প্রকল্পটির বিষয়ে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা
যাচাই ছাড়াই অনুমোদন করায় ক্ষোভও প্রকাশ করে কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের
ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, পুরো প্রকল্পটির অর্থ
ব্যয়ের বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ ও সেমিনার-সংক্রান্ত
প্রকল্পে অর্থ লুটপাট ছাড়া অগ্রগতি কিছুই হয় না। বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশন
অবগত হলেও সরকারের শীর্ষপর্যায়ের চাপে অর্থ বরাদ্দ দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে
যতটা সম্ভব অর্থ কাটছাঁট করা হয়েছে।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের দাবি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৫৫ হাজার দক্ষ আইটি বা
আইসিটি ফ্রিল্যান্স্যার তৈরি হবে। বৈশ্বিক বাজারে ফ্রিল্যান্সিং বা
আউটসোর্সিং বিষয়ে সচেতনতা ও নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং
ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিংয়ের কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে এ
অর্থ প্রয়োজন। তবে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবদুল মান্নান
হাওলাদার বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে প্রশিক্ষণ
এবং সেমিনারের জন্য ১৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের
মেয়াদ ধরে এটি অনুমোদনের সুপারিশ করেছি।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগে আইসিটি প্রশিক্ষণের নামে যেসব প্রকল্পে
বরাদ্দ হয়েছে, তা কোনো কাজে আসেনি। অনভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ
শেষ করা হয়েছে। দেশে যেসব ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত বা কাজ
করছেন, তারা সবাই নিজস্ব যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয়
করছেন। শ্রীলংকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো
আবু সাইদ খান বলেন, এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে আগে যেসব কর্মসূচি
বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোর প্রভাব মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। মূল্যায়নের
ফলাফল ইতিবাচক হলেই শুধু অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা রয়েছে। অন্যথায় সরকারি
অর্থে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেয়াই ভালো।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে
ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দেয়া হলে আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য আসবে।
জাতীয় পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত তৃণমূল পর্যায়ে বেসিক আইসিটি বিষয়ে
প্রশিক্ষণ দেয়া হলে ঘরে বসেই বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন সম্ভব হবে। একই
সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে আইসিটিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে সেলফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

Comments

Unknown said…
freelancing asola ki ame bojina amak akto bolben